টেক্সাসের স্টারবেসে (Starbase, Texas) অবস্থিত স্পেসএক্সের (SpaceX) লঞ্চ সাইট এক দশক আগে ছিল বালুকাময় মরুভূমির একটি প্রান্তর। সেখানে শুধু ছিল কিছু বালির ঢিবি আর ড্রাগন স্পেসক্রাফটের (Dragon Spacecraft) সঙ্গে যোগাযোগের জন্য স্যাটেলাইট ডিশ। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি স্পেসএক্স একটি ছোট লঞ্চ প্যাড তৈরি করে এবং স্টারহপার (Starhopper) প্রোটোটাইপের প্রথম দুটি ফ্লাইট পরীক্ষা করে। এরপর থেকে তাঁবু, হাই বে (High Bay) এবং অবশেষে বিশাল স্টারফ্যাক্টরি (Starfactory) নির্মাণের মাধ্যমে স্টারবেস একটি আধুনিক শিল্প কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে।
এই বছরের শুরুতে উদ্বোধন হওয়া স্টারফ্যাক্টরি একটি বিশাল রকেট কারখানা, যা প্রায় ১০ লক্ষ বর্গফুট জায়গা জুড়ে অবস্থিত। এটি ক্যালিফোর্নিয়ার হথর্নে অবস্থিত স্পেসএক্সের ফ্যালকন ৯ (Falcon 9) কারখানার দ্বিগুণ বড়। এই কারখানার লক্ষ্য প্রতিদিন একটি স্টারশিপ (Starship) রকেট তৈরি করা, যা অ্যাপোলো প্রোগ্রামের স্যাটার্ন ৫ (Saturn V) রকেটের তুলনায় অনেক বড়। স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক (Elon Musk) বলেছেন, “মেশিন তৈরির মেশিন নির্মাণ করা মেশিনের চেয়ে অনেক জটিল।” স্টারফ্যাক্টরি এই জটিল কাজের প্রমাণ।
স্টারফ্যাক্টরির ভেতরে
স্টারফ্যাক্টরির প্রধান প্রবেশপথে একটি আধুনিক লবি রয়েছে, যেখান থেকে বিশাল কারখানার ফ্লোর দৃশ্যমান। তিনতলা ভবনে অফিস, কনফারেন্স রুম এবং লঞ্চ কন্ট্রোল সেন্টার রয়েছে। উপরের তলাগুলো থেকে স্টারশিপের লঞ্চ সাইটের দৃশ্য দেখা যায়। কারখানার ফ্লোরে নোজ কোন (Nose Cone), গ্রিড ফিন (Grid Fin) এবং হট স্টেজিং রিং (Hot Staging Ring) সহ বিভিন্ন স্টারশিপের অংশ তৈরি হচ্ছে। কারখানার গুঞ্জন ও যন্ত্রপাতির শব্দ একটি জীবন্ত শিল্পকেন্দ্রের চিত্র তুলে ধরে।
স্টারশিপের চ্যালেঞ্জ
২০২৫ সালে স্টারশিপ প্রোগ্রামটি বড় ধরনের ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছে। জানুয়ারি, মার্চ এবং মে মাসে তিনটি পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন ব্যর্থ হয়েছে, যেখানে স্টারশিপের উপরের অংশ (Upper Stage) উড্ডয়নের সময় সমস্যার সম্মুখীন হয়। জুন মাসে একটি স্ট্যাটিক ফায়ার টেস্টের (Static Fire Test) সময় আরেকটি স্টারশিপ বিস্ফোরিত হয়। এই ব্যর্থতাগুলো স্পেসএক্সের জন্য বড় ধাক্কা, কারণ স্টারশিপ নাসার আর্টেমিস ৩ মিশনের (Artemis III Mission) জন্য চাঁদে অবতরণকারী যান হিসেবে নির্বাচিত।
স্পেসএক্সের ইঞ্জিনিয়াররা বিশ্বাস করেন যে স্টারশিপের মৌলিক ডিজাইন ঠিক আছে এবং সমস্যাগুলো সমাধানযোগ্য। তারা আশা করছেন যে নতুন “ভার্সন ৩” (Version 3) স্টারশিপ, যা ২০২৫ সালের শেষে বা ২০২৬ সালের শুরুতে উড্ডয়ন করবে, আরও নির্ভরযোগ্য হবে। তবে, আসন্ন ২৪ আগস্টের দশম পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন (Flight Test) এবং পরবর্তী ফ্লাইটগুলো এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আর্টেমিস মিশন ও চীনের প্রতিযোগিতা
নাসার আর্টেমিস প্রোগ্রামের (Artemis Program) লক্ষ্য ২০২৭ সালে চাঁদে মানুষ পাঠানো, যেখানে স্টারশিপ মানব অবতরণ ব্যবস্থা (Human Landing System) হিসেবে কাজ করবে। তবে, স্টারশিপের ব্যর্থতার কারণে এই সময়সীমা ২০২৮ বা এমনকি ২০৩০ সালে পিছিয়ে যেতে পারে। এদিকে, চীন (China) ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা করছে, যা নাসার জন্য প্রতিযোগিতার চাপ তৈরি করছে।
ইলন মাস্ক প্রকাশ্যে বলেছেন, চাঁদে পুনরায় অবতরণের চেয়ে মঙ্গল (Mars) মিশন তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে ৫৬ বছর আগে চাঁদে পৌঁছেছে, তাই মঙ্গলই পরবর্তী লক্ষ্য হওয়া উচিত। তবে, আর্টেমিস মিশনের জন্য স্টারশিপের সাফল্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ছাড়া নাসার চাঁদে ফেরার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন।
স্টারশিপের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
স্টারশিপের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জনের জন্য স্পেসএক্সকে বেশ কয়েকটি জটিল কাজ সম্পন্ন করতে হবে:
- পুনঃব্যবহারযোগ্যতা (Reuse): তাপরক্ষক ঢাল (Heat Shield) তৈরি এবং স্টারশিপের উপরের অংশ পুনরায় উড্ডয়ন ও অবতরণ।
- প্রোপেলান্ট স্থানান্তর (Propellant Transfer): নিম্ন পৃথিবী কক্ষপথে (Low Earth Orbit) প্রোপেলান্ট স্থানান্তর পরীক্ষা।
- ক্রায়োজেনিক ডিপো (Cryogenic Depots): দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানি সংরক্ষণের জন্য ডিপো তৈরি।
- চাঁদে অবতরণ (Lunar Landing): স্টারশিপের উচ্চতা এবং চাঁদের অমসৃণ ভূখণ্ডের কারণে অবতরণ চ্যালেঞ্জিং।
- চাঁদ থেকে উড্ডয়ন (Lunar Launch): অবকাঠামো ছাড়াই চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে নিরাপদ উড্ডয়ন।
- মঙ্গল মিশন (Mars Transit): মঙ্গলে দীর্ঘমেয়াদী অভিযান এবং নিয়ন্ত্রিত অবতরণ।
এই প্রতিটি পদক্ষেপ অত্যন্ত জটিল এবং মহাকাশ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন। স্পেসএক্সের “পরীক্ষা, উড্ডয়ন, মেরামত” (Test, Fly, Fix) পদ্ধতি অতীতে সফল হলেও, স্টারশিপের উপরের অংশের স্থিতিশীল উড্ডয়ন ছাড়া এই মাইলফলকগুলো অর্জন কঠিন।
রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক চাপ
২০২৫ সালে স্টারশিপের ব্যর্থতার পাশাপাশি ইলন মাস্ক রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়েছেন, যা স্পেসএক্সের সরকারি চুক্তির উপর প্রভাব ফেলতে পারে। মার্কিন সরকারের কিছু কর্মকর্তা স্পেসএক্সের বিকল্প খুঁজছেন, যদিও বর্তমানে স্পেসএক্সের পরিষেবাগুলো নাসা ও প্রতিরক্ষা বিভাগের জন্য অপরিহার্য। হোয়াইট হাউস ২০২৬ সালের বাজেটে আর্টেমিস ৩-এর পর নাসার স্পেস লঞ্চ সিস্টেম (SLS) বন্ধের প্রস্তাব করেছে, যা স্টারশিপের উপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাৎপর্য
বাংলাদেশের প্রযুক্তি উৎসাহী এবং শিক্ষার্থীদের জন্য স্টারশিপ প্রোগ্রাম মহাকাশ গবেষণার একটি উত্তেজনাপূর্ণ সম্ভাবনা। এটি প্রমাণ করে যে ব্যর্থতার মধ্য দিয়েও উদ্ভাবন সম্ভব। তবে, স্টারশিপের ব্যর্থতা এবং আর্টেমিস মিশনের বিলম্ব বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের জন্য একটি শিক্ষা—মহাকাশ প্রযুক্তির জটিলতা এবং ধৈর্যের প্রয়োজনীয়তা।