এনভিডিয়া (NVIDIA), বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় চিপ নির্মাতা, চীনের বাজারের জন্য তৈরি এইচ২০ এআই চিপ (H20 AI chip) উৎপাদন বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ‘দ্য ইনফরমেশন’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এনভিডিয়া তাদের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যেমন আমেরিকার অ্যারিজোনাভিত্তিক অ্যামকর টেকনোলজি (Amkor Technology) এবং দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং ইলেকট্রনিক্স (Samsung Electronics)-কে এইচ২০ চিপের উৎপাদন স্থগিত রাখতে বলেছে। অ্যামকর এই চিপের জন্য উন্নত প্যাকেজিং (advanced packaging) সরবরাহ করে, আর স্যামসাং মেমরি (memory) সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে। এছাড়া, রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনভিডিয়া তাইওয়ানের ফক্সকন (Foxconn)-কেও, যারা এই চিপের ব্যাকএন্ড প্রসেসিং (backend processing)-এর কাজ করে, উৎপাদন বন্ধ করতে বলেছে। এনভিডিয়ার একজন মুখপাত্র সিএনবিসি-কে জানিয়েছেন, “আমরা বাজারের পরিস্থিতি অনুযায়ী আমাদের সরবরাহ চেইন (supply chain) নিয়ন্ত্রণ করি।”
এই সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান প্রযুক্তিগত উত্তেজনা। গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এইচ২০ চিপ চীনে বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, উদ্বেগ প্রকাশ করে যে চীন এই চিপ ব্যবহার করে তাদের সামরিক বাহিনীর জন্য এআই প্রযুক্তি (AI technology) উন্নত করতে পারে। তবে, জুলাই মাসে ট্রাম্প প্রশাসন একটি চুক্তির মাধ্যমে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়, যেখানে এনভিডিয়াকে চীনে বিক্রির রাজস্বের ১৫% যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে দেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়।
কিন্তু চীন এইচ২০ চিপকে খোলা হাতে গ্রহণ করেনি। চীনের সাইবারস্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (Cyberspace Administration of China) বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানি যেমন বাইটডান্স (ByteDance), আলিবাবা (Alibaba) এবং টেনসেন্ট (Tencent)-কে এইচ২০ চিপের নতুন অর্ডার বন্ধ করতে নির্দেশ দেয়, নিরাপত্তা উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে। চীনা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে যে এই চিপে ‘ব্যাকডোর’ (backdoor) থাকতে পারে, যার মাধ্যমে এটি দূরবর্তীভাবে নিয়ন্ত্রিত বা ট্র্যাক করা সম্ভব। এনভিডিয়ার প্রধান নির্বাহী জেনসেন হুয়াং (Jensen Huang) এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, “আমরা চীন সরকারকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছি যে এই ধরনের কোনো ব্যাকডোর নেই। আশা করি আমাদের জবাব তাদের জন্য যথেষ্ট হবে।”
এদিকে, ফিনান্সিয়াল টাইমসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের এই সতর্কতার পেছনে কেবল নিরাপত্তা উদ্বেগই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সচিব হাওয়ার্ড লুটনিকের (Howard Lutnick) কিছু মন্তব্যও কারণ হিসেবে কাজ করেছে। লুটনিক বলেছিলেন, “আমরা চীনকে আমাদের সেরা প্রযুক্তি বিক্রি করি না, এমনকি দ্বিতীয় বা তৃতীয় সেরাও নয়। আমরা তাদের চতুর্থ স্তরের প্রযুক্তি দিই, যাতে তারা আমাদের প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।” এই মন্তব্য চীনা কর্তৃপক্ষের কাছে অপমানজনক বলে বিবেচিত হয়েছে।
এইচ২০ বর্তমানে চীনের বাজারে এনভিডিয়ার সবচেয়ে উন্নত এআই চিপ। তবে, রয়টার্সের খবর অনুযায়ী, এনভিডিয়া এখন আরও শক্তিশালী একটি চিপ তৈরি করছে, যা তাদের ব্ল্যাকওয়েল আর্কিটেকচারের (Blackwell architecture) উপর ভিত্তি করে হবে এবং এটি ব্ল্যাকওয়েল আলট্রা জিপিইউ (Blackwell Ultra GPUs)-এর অর্ধেক কম্পিউটিং ক্ষমতা সম্পন্ন হবে।
সাংস্কৃতিক ও প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষাপট:
চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান প্রযুক্তি যুদ্ধ (tech war) এবং চীনের নিজস্ব এআই চিপ শিল্পের উত্থান, যেমন হুয়াওয়ে (Huawei)-এর মতো কোম্পানির অগ্রগতি, এই ঘটনাকে আরও জটিল করে তুলেছে। চীন তাদের প্রযুক্তি খাতে স্বনির্ভরতা (self-sufficiency) অর্জনের জন্য জোর দিচ্ছে, যা এনভিডিয়ার মতো বিদেশি কোম্পানির জন্য বাজারে টিকে থাকা কঠিন করে তুলছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, এই ঘটনা প্রযুক্তি আমদানি ও নিরাপত্তা নিয়ে ভবিষ্যৎ আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, কারণ আমাদের দেশও ক্রমশ এআই এবং উন্নত প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে।
উপসংহার:
এনভিডিয়ার এইচ২০ চিপ উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত চীনের বাজারে তাদের অবস্থানকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে। নিরাপত্তা উদ্বেগ, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং চীনের স্থানীয় প্রযুক্তি শিল্পের উত্থানের মধ্যে এনভিডিয়াকে নতুন কৌশল নিয়ে এগোতে হবে। এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি শিল্পের গতিশীলতার একটি প্রতিচ্ছবি, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্যও শিক্ষণীয়।