গুগল দীর্ঘদিনের অ্যাপ স্টোর অ্যান্টিট্রাস্ট মামলায় তাদের আপিলে হেরেছে, যা ফর্টনাইট নির্মাতা এপিক গেমসের জন্য আরেকটি বড় জয়। ২০২৩ সালে একটি জুরি রায় দিয়েছিল যে, গুগল স্মার্টফোন বাজারে তাদের অবস্থানের অপব্যবহার করে এপিক এবং অন্যান্যদের প্রতিযোগিতা থেকে বাধা দিয়েছে। গুগল আপিলের সময় শাস্তি স্থগিত রাখতে সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু এখন তাদের অ্যান্ড্রয়েডের জন্য আরও উন্মুক্ত ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে হবে।
মামলার উৎপত্তি
মোবাইল অ্যাপ যুগের শুরু থেকে, অ্যাপল এবং গুগল উভয়ই ডেভেলপারদের রাজস্বের একটি বড় অংশ (১৫-৩০%) কমিশন হিসেবে নিয়ে আসছিল। এই স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো সম্পদ কারও ছিল না, যতক্ষণ না এপিকের ফর্টনাইট গেমটি বিশাল সাফল্য লাভ করে। ২০২০ সালে এপিক তাদের ফ্রি-টু-প্লে গেমে বাহ্যিক পেমেন্ট অপশন যুক্ত করে, যার ফলে গুগল এবং অ্যাপল উভয়ই তাদের স্টোর থেকে ফর্টনাইট সরিয়ে দেয়। এরপরেই এপিক গুগল এবং অ্যাপলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
গুগলের বিরুদ্ধে এপিকের সাফল্য
অ্যাপলের তুলনায় গুগলের অ্যাপ স্টোর তুলনামূলকভাবে কম সীমাবদ্ধ হলেও, এপিক অ্যাপলের বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পারেনি। তবে, ২০২৩ সালে মার্কিন জেলা বিচারক জেমস ডোনাটোর তত্ত্বাবধানে গুগলের মামলায় প্রকাশ পায় যে, গুগল অ্যান্ড্রয়েড ফোনে বিকল্প অ্যাপ স্টোর বিতরণ রোধ করতে ষড়যন্ত্র করেছে। যদিও অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসে অ্যাপ সাইডলোডিং এবং ওপেন-সোর্স প্ল্যাটফর্মের সুবিধা রয়েছে, গুগলের বিশাল স্কেল এবং ডিভাইস নির্মাতাদের সঙ্গে অংশীদারিত্ব এটিকে একটি ডি ফ্যাক্টো একচেটিয়া অবস্থানে নিয়ে গেছে। এই কারণে আদালত গুগলের উপর ব্যাপক প্রতিকার আরোপ করে, যা মোবাইল অ্যাপ ইকোসিস্টেমকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে পারে।
গুগলের আপিলের যুক্তি
গুগল আপিলে দাবি করে যে, মূল বিচারে ত্রুটি ছিল। তারা বলে, প্লে স্টোর অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে, কিন্তু জুরির কাছে এই যুক্তি উপস্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়নি। এছাড়া, গুগল দাবি করে যে, এপিকের মামলা জুরির পরিবর্তে একজন বিচারকের দ্বারা সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল, কারণ এটি গুগলের আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিষেধাজ্ঞা চেয়েছিল, ক্ষতিপূরণ নয়। গুগল আরও বলে, বিচারক ডোনাটোর আরোপিত প্রতিকারগুলো অত্যধিক ব্যয়বহুল এবং তাদের নতুন পণ্য ও পরিষেবা তৈরি করতে বাধ্য করছে।
আপিলের রায়
বিচারক মার্গারেট ম্যাককিওনের লেখা রায়ে জুরির রায় নিশ্চিত করা হয়েছে এবং গুগলের আপত্তিগুলো খারিজ করা হয়েছে। তিনি লিখেছেন, “রেকর্ডে প্রচুর প্রমাণ রয়েছে যে গুগলের প্রতিযোগিতাবিরোধী আচরণ তার আধিপত্যকে আরও শক্তিশালী করেছে, যার ফলে প্লে স্টোর নেটওয়ার্ক প্রভাব থেকে উপকৃত হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “এই প্রতিকারগুলো এবং তাদের পরিধি রেকর্ড এবং বাজারের প্রকৃতি দ্বারা সমর্থিত, এবং আমরা দায়বদ্ধতার রায় এবং সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে এগুলো সমর্থন করি।”
প্লে স্টোরে আসন্ন পরিবর্তন
গুগলের আপিল ব্যর্থ হওয়ায়, তাদের এখন প্লে স্টোরে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে:
- তৃতীয় পক্ষের বিলিং সিস্টেম: গুগলকে ডেভেলপারদের গুগল প্লে বিলিং সিস্টেম ব্যবহারে বাধ্য করা বন্ধ করতে হবে, যা তৃতীয় পক্ষের পেমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে ডেভেলপারদের বেশি রাজস্ব অর্জনের সুযোগ দেবে।
- এক্সক্লুসিভিটি প্রণোদনা বন্ধ: তিন বছরের জন্য গুগল ডেভেলপারদের তাদের প্ল্যাটফর্মে এক্সক্লুসিভ কনটেন্ট লঞ্চের জন্য প্রণোদনা দেওয়া বন্ধ করবে।
- তৃতীয় পক্ষের অ্যাপ স্টোর: গুগলকে তৃতীয় পক্ষের অ্যাপ স্টোরগুলো প্লে স্টোরের মাধ্যমে বিতরণের অনুমতি দিতে হবে। এপিকের সিইও টিম সুইনি এই রায় উদযাপন করে বলেছেন, এপিক গেমস স্টোর শীঘ্রই প্লে স্টোরে আসছে।
- অ্যাপ ক্যাটালগ শেয়ারিং: গুগলকে তাদের প্লে স্টোরের সম্পূর্ণ অ্যাপ ক্যাটালগ অন্য অ্যাপ স্টোরে বিতরণের জন্য উপলব্ধ করতে হবে, তবে ডেভেলপাররা চাইলে তাদের অ্যাপ বাদ দেওয়ার সুযোগ পাবেন।
গুগলের প্রতিক্রিয়া এবং ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
গুগলের নিয়ন্ত্রক বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট লি-অ্যান মুলহল্যান্ড বলেছেন, “এই সিদ্ধান্ত ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তাকে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, পছন্দ সীমিত করবে এবং অ্যান্ড্রয়েড ইকোসিস্টেমের উদ্ভাবনকে ক্ষুণ্ন করবে।” গুগল মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে, তবে সুপ্রিম কোর্ট এটি শুনবে বা গুগলের পক্ষে রায় দেবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রভাব
বাংলাদেশে অ্যান্ড্রয়েড ফোনের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে এই রায় স্থানীয় ডেভেলপার এবং ব্যবহারকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গুগলের ৩০% কমিশন কাটছাঁট বাংলাদেশের অ্যাপ ডেভেলপারদের জন্য একটি বড় বাধা ছিল। তৃতীয় পক্ষের বিলিং সিস্টেম এবং অ্যাপ স্টোরের প্রবর্তন ডেভেলপারদের রাজস্ব বাড়াতে এবং ব্যবহারকারীদের জন্য আরও সাশ্রয়ী মূল্যে অ্যাপ সরবরাহ করতে সাহায্য করবে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের গেমিং ডেভেলপাররা তাদের অ্যাপের মাধ্যমে সরাসরি পেমেন্ট গ্রহণ করে গুগলের কমিশন এড়াতে পারবেন, যা তাদের ব্যবসায়িক মডেলকে আরও লাভজনক করবে।
তবে, গুগলের দাবি যে এই পরিবর্তন ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে, তা বাংলাদেশের ব্যবহারকারীদের জন্যও বিবেচনার বিষয়। বাংলাদেশে ফিশিং এবং ম্যালওয়্যার অ্যাপের ঝুঁকি ইতিমধ্যে উদ্বেগজনক। তৃতীয় পক্ষের অ্যাপ স্টোরে অ্যাপগুলোর নিরাপত্তা যাচাইয়ের কঠোর প্রক্রিয়া না থাকলে, ব্যবহারকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
উপসংহার
এই রায় অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ ইকোসিস্টেমের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। গুগলকে তাদের প্লে স্টোরকে আরও উন্মুক্ত করতে হবে, যা ডেভেলপার এবং ব্যবহারকারীদের জন্য বেশি পছন্দ এবং প্রতিযোগিতার সুযোগ তৈরি করবে। তবে, গুগলের সম্ভাব্য সুপ্রিম কোর্ট আপিল এই পরিবর্তনগুলোর বাস্তবায়নকে বিলম্বিত করতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, এই পরিবর্তন স্থানীয় অ্যাপ ডেভেলপারদের জন্য নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করলেও, ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি চ্যালেঞ্জ হবে।