ইন্টারপোল গত শুক্রবার ঘোষণা করেছে যে, আফ্রিকার ১৮টি দেশের কর্তৃপক্ষ ১২০৯ জন সাইবার অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেছে, যারা প্রায় ৮৮,০০০ ভুক্তভোগীকে লক্ষ্য করেছিল। এই অভিযানে ৯৭.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার উদ্ধার করা হয়েছে এবং ১১,৪৩২টি ক্ষতিকারক অবকাঠামো ধ্বংস করা হয়েছে, যা সাইবার অপরাধের বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে।
এই অভিযানটি ‘অপারেশন সেরেঙ্গেটি ২.০’ নামে পরিচিত একটি চলমান আইন প্রয়োগকারী উদ্যোগের দ্বিতীয় ধাপ, যা ২০২৫ সালের জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত পরিচালিত হয়েছিল। এর লক্ষ্য ছিল র্যানসমওয়্যার, অনলাইন জালিয়াতি এবং বিজনেস ইমেইল কম্প্রোমাইজ (BEC) এর মতো গুরুতর অপরাধ মোকাবেলা করা। গত বছরের শেষের দিকে এই অভিযানের প্রথম ধাপে গ্রেপ্তার হয়েছিল ১০০০ জনেরও বেশি সন্দেহভাজন।
অভিযানের উল্লেখযোগ্য ফলাফল:
- অ্যাঙ্গোলায় ক্রিপ্টো মাইনিং ধ্বংস: অ্যাঙ্গোলায় ২৫টি অবৈধ ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিং কেন্দ্র ধ্বংস করা হয়েছে, যেখানে ৬০ জন চীনা নাগরিক জড়িত ছিল। ৪৫টি অবৈধ বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ৩৭ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের মাইনিং ও আইটি সরঞ্জাম বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এই সরঞ্জামগুলো এখন দুর্বল এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণে সহায়তার জন্য ব্যবহার করা হবে।
- জাম্বিয়ায় বিশাল জালিয়াতি প্রকল্প ভেঙে দেওয়া: জাম্বিয়ায় ৬৫,০০০ ভুক্তভোগীকে টার্গেট করে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের একটি অনলাইন বিনিয়োগ জালিয়াতি প্রকল্প ধ্বংস করা হয়েছে। প্রতারকরা উচ্চ লাভের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করেছিল। ১৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছে এবং ডোমেইন, মোবাইল নম্বর ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া, একটি স্ক্যাম সেন্টার এবং একটি সন্দেহভাজন মানব পাচার নেটওয়ার্কও ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
- জার্মানি-উৎপত্তি উত্তরাধিকার জালিয়াতি: কোট ডি’আইভরে জার্মানি থেকে উদ্ভূত একটি আন্তর্জাতিক উত্তরাধিকার জালিয়াতি (inheritance scam) ধ্বংস করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের ১.৬ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছিল। প্রধান সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ইলেকট্রনিক্স, গয়না, নগদ টাকা ও যানবাহন জব্দ করা হয়েছে।
ইন্টারপোলের মহাসচিব ভালডেসি উরকুইজা বলেছেন, “প্রতিটি ইন্টারপোল-সমন্বিত অভিযান পূর্ববর্তী অভিযানের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, সহযোগিতা গভীর করে, তথ্য আদান-প্রদান বাড়ায় এবং সদস্য দেশগুলোর মধ্যে তদন্ত দক্ষতা বৃদ্ধি করে। আরও অবদান এবং ভাগ করা দক্ষতার মাধ্যমে ফলাফলের পরিধি ও প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।”
সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক সাইবার নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান গ্রুপ-আইবি (Group-IB) জানিয়েছে, তারা ক্রিপ্টোকারেন্সি জালিয়াতি এবং বিইসি (business email compromise) প্রচারণার সাথে সম্পর্কিত গোয়েন্দা তথ্য এবং অবকাঠামোগত বিবরণ সরবরাহ করেছে। গ্রুপ-আইবি’র সিইও দিমিত্রি ভলকভ বলেন, “সাইবার অপরাধের কোনো সীমানা নেই, এবং এর প্রভাব সত্যিই বিশ্বব্যাপী। অপারেশন সেরেঙ্গেটি ২.০-এর সাফল্য প্রমাণ করে যে, জাতিগুলো একসঙ্গে দাঁড়ালে কী অর্জন করা সম্ভব।”
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ঘটনা:
নাইজেরিয়া সম্প্রতি ১০২ জন বিদেশী নাগরিককে, যার মধ্যে ৬০ জন চীনা এবং ৩৯ জন ফিলিপিনো রয়েছে, সাইবার সন্ত্রাস এবং ইন্টারনেট জালিয়াতির দায়ে নির্বাসন দিয়েছে। এই ব্যক্তিরা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে গ্রেপ্তার ৭৯২ জন সন্দেহভাজন সাইবার অপরাধীর মধ্যে ছিল। এছাড়া, ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ‘অপারেশন রেড কার্ড’ নামে আরেকটি আন্তর্জাতিক অভিযানে সাতটি আফ্রিকান দেশে ৩০৬ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৮৪২টি ডিভাইস জব্দ করা হয়।
সাংস্কৃতিক ও প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষাপট:
আফ্রিকার দ্রুত ডিজিটালাইজেশন (digitization) এবং সীমিত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে এই মহাদেশটি সাইবার অপরাধীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। অ্যাঙ্গোলার অবৈধ বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং জাম্বিয়ার মানব পাচার নেটওয়ার্কের সাথে সাইবার অপরাধের সংযোগ দেখায় যে, এই অপরাধগুলো কেবল ডিজিটাল জগতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর বাস্তব জীবনেও গভীর প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, এই ঘটনা আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। আমাদের দেশেও অনলাইন জালিয়াতি এবং সাইবার অপরাধ বাড়ছে, এবং এই ধরনের অভিযান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন।
উপসংহার:
অপারেশন সেরেঙ্গেটি ২.০ বিশ্বব্যাপী সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি বড় পদক্ষেপ। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান এবং উন্নত তদন্ত কৌশলের মাধ্যমে এই অভিযান উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। তবে, সাইবার অপরাধীরা দ্রুত নতুন কৌশল অবলম্বন করে, তাই ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য এটি একটি শিক্ষা—ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং সচেতনতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।